মানব ইতিহাসের পুরোটা জুড়ে পৃথিবীর ওপর চাঁদের উপস্থিতি একেবারে অবিচ্ছেদ্য
শত শত কোটি বছর আগে পৃথিবীতে দিনের বেলার দৈর্ঘ্য গড়ে ১৩ ঘণ্টারও কম ছিল এবং এখন এটি বাড়ছে। এর পেছনে প্রধান কারণটি হলো চাঁদ এবং আমাদের মহাসাগরের মধ্যে সম্পর্ক।
মানব ইতিহাসের পুরোটা জুড়ে পৃথিবীর ওপর চাঁদের উপস্থিতি একেবারে অবিচ্ছেদ্য, এবং খানিকটা ভুতুড়ে।
এর মৃদু মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটার ছন্দ নির্ধারিত হয়, এর ফ্যাকাসে আলোয় অনেক প্রজাতির নিশাচর প্রাণী যৌনকর্মে লিপ্ত হয়।
বিশ্বে এপর্যন্ত যতগুলো সভ্যতা এসেছে তার সবাই শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের ওপর ভিত্তি করে তাদের ক্যালেন্ডার কিংবা পঞ্জিকা তৈরি করেছে।
এবং কিছু কিছু প্রাণী, যেমন গুবরে পোকা, চাঁদের পীঠ থেকে প্রতিফলিত সূর্যের আলো ব্যবহার করে রাতে চলাফেরা করে।
আরও গুরুত্বপূর্ণ যেটা তা হলো: কিছু কিছু তত্ত্ব অনুযায়ী, চাঁদ এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে সাহায্য করেছে যার মাধ্যমে আমাদের গ্রহে জীবনের বিকাশকে সম্ভব করে তুলেছে এবং এমনকি একেবারে গোড়ার দিকে চাঁদই পৃথিবীতে জীবন শুরু করতেও সাহায্য করেছে বলেও মনে করা হয়।
আমাদের গ্রহের চারপাশে চাঁদের উদ্ভট কক্ষপথ এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবহাওয়া ব্যবস্থা তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করা হয় যা আজ পর্যন্ত আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছে।
কিন্তু সেই চাঁদ আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে তার সূক্ষ্মভাবে ভারসাম্যপূর্ণ অ্যাস্ট্রো-ব্যালের মাধ্যমে প্রদক্ষিণ করে, কিন্তু কখনই নিজে ঘুরপাক খায় না।
সে কারণে আমরা সব সময় চাঁদের একটি মাত্র পীঠই দেখতে পাই।
কিন্তু “লুনার রিসেশন” নামে এক প্রক্রিয়ার ফলে চাঁদ ধীরে ধীরে আমাদের গ্রহ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
অ্যাপোলো মিশনের মহাকাশচারীরা চাঁদের পীঠে যেসব রিফ্লেক্টার বা প্রতিফলক বসিয়েছিলেন তার ওপর লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করে বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি শতভাগ নির্ভুলতার সাথে পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছেন যে চাঁদ ঠিক কত দ্রুত গতিতে পৃথিবীর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
তারা নিশ্চিত করছেন, চাঁদ প্রতি বছর ১.৫ ইঞ্চি (৩.৮ সেমি) হারে দূরে সরে যাচ্ছে। এবং এর ফলে আমাদের দিনের দৈর্ঘ্য একটু একটু করে বাড়ছে।
"এসবই হচ্ছে জোয়ারের জন্য," বলছেন লন্ডনের রয়্যাল হলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিও-ফিজিক্সের অধ্যাপক ডেভিড ওয়ালথাম। চাঁদ ও পৃথিবীর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে তিনি গবেষণা করেন।
"জোয়ারের টানের ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণন ধীর হয়ে আসে, এবং সেই শক্তিতে চাঁদে কৌণিক ভরবেগ তৈরি হয়।"
মূলত, পৃথিবী তার কক্ষপথে ঘোরার সাথে সাথে একটু দূরে চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সমুদ্রে জোয়ার ও ভাটার সৃষ্টি করে।
এই জোয়ার সমুদ্রের পানিকে ‘ফুলিয়ে’ দেয় যা উপবৃত্তের আকারে একবার চাঁদের অভিকর্ষের দিকে এবং অন্যবার বিপরীত দিকে প্রসারিত হয়।
কিন্তু যেহেতু পৃথিবী তার অক্ষের ওপর চাঁদের কক্ষপথের চেয়েও অনেক বেশি দ্রুতবেগে ঘুরছে, তাই চাঁদের নীচের সমুদ্রের অববাহিকাগুলোর সাথে ঘর্ষণের কারণে চাঁদ সেই জলকে টেনে ধরে রাখতে কাজ করে।
এর মানে হলো, সমুদ্রের জলের এই ফুলে ওঠার ব্যাপারটি ঘটে চাঁদের কক্ষপথের কিছুটা সামনে।
চাঁদ তখন এটিকে পেছনের দিকে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করে। ফলে সামান্য হলেও এটি আমাদের গ্রহের ঘূর্ণন শক্তিকে কমিয়ে দেয়।
চাঁদের শক্তি অর্জনের সময় পৃথিবীর আরও ঘূর্ণন ধীর হয়ে যায়, যার ফলে চাঁদ একটু ওপরের কক্ষপথে সরে আসে।
সর্বশেষ বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আমাদের গ্রহের ঘূর্ণনের এই ক্রমবর্ধমান ধীরগতির মানে হল যে ১৬০০ শতকের শেষের দিক থেকে পৃথিবীতে দিনের দৈর্ঘ্য প্রতি শতাব্দীতে গড়ে প্রায় ১.০৯ মিলি-সেকেন্ড হারে বেড়েছে।
চন্দ্র গ্রহণের ওপর প্রাচীন পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি অন্যান্য পরিমাপগুলিতে এই সংখ্যাকে আরও একটু বেশি করে দেখানো হয়েছে – প্রতি শতাব্দীতে ১.৭৮ মিলি-সেকেন্ড হারে।
এমনিতে এটি খুব বেশি বলে মনে না হলেও পৃথিবীর সাড়ে চারশো কোটি বছরের ইতিহাসে এটা এক গভীর পরিবর্তনকে তুলে ধরে।
সৌরজগতের জন্মের পরে প্রথম পাঁচ কোটি বছর পর বা তার কাছাকাছি সময়ে চাঁদ তৈরি হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
এনিয়ে সবচেয়ে বেশি যে তত্ত্বটিকে মেনে নেয়া হয় তা হলো: পৃথিবী যখন মাত্র গঠিত হয়েছে বা হচ্ছে, সে সময় মঙ্গল গ্রহের আকারের অন্য একটি বস্তু, যেটি থিয়া নামে পরিচিত, তার সাথে সংঘর্ষ ঘটে।
এর ফলে পৃথিবীর একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যাকে এখন আমরা চাঁদ বলে ডাকি।
পৃথিবীতে পাথরের স্তরের মধ্যে সংরক্ষিত ভূতাত্ত্বিক তথ্য থেকে এখন যেটা স্পষ্ট হচ্ছে তা হলো: আজকের তুলনায় অতীতে চাঁদ পৃথিবীর অনেক কাছাকাছি জায়গায় ছিল।
বর্তমানে চাঁদের অবস্থান পৃথিবী থেকে ৩,৮৪,০০০ কি.মি. (২,৩৮,৮৫৫ মাইল) দূরে।
কিন্তু একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৩২০ কোটি বছর আগে যখন পৃথিবীর টেকটনিক প্লেটগুলো মাত্র ঘুরতে শুরু করেছিল এবং মহাসাগরে বসবাসকারী অণুজীবগুলি নাইট্রোজেন খেতে শুরু করেছিল, সেই সময়ে চাঁদ পৃথিবী থেকে মাত্র ২,৭০,০০০ কি.মি. (১,৭০,০০০ মাইল) দূরে অবস্থিত ছিল, যা বর্তমান দূরত্বের তুলনায় প্রায় ৭০%।
"সেই সময় পৃথিবী এত দ্রুত গতিতে ঘুরতো যে তা দিনের দৈর্ঘ্য কমিয়ে দিয়েছিল। তখন [২৪ ঘণ্টার মধ্যে] দুটি সূর্যোদয় এবং দুটি সূর্যাস্ত ছিল, এখনকার মতো একটি করে নয়," বলেছেন জার্মানির ফ্রিডরিশ শিলার ইউনিভার্সিটির ভূ-পদার্থবিদ টম ইউলেনফেল্ড।
"এটি হয়তো দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমিয়ে এনেছে এবং সালোক-সংশ্লেষণকারী যেসব জীব তাদের জৈব রসায়নকে প্রভাবিত করেছে।"
তার এবং অন্যান্যদের গবেষণা থেকে যা জানা যাচ্ছে তা হলো, লুনার রিসেশনের হারও কিন্তু সব সময় একই ছিল না - সময়ের সাথে সাথে এর গতি কখনও বেড়েছে এবং আবার কখনও কমে গেছে।
আর্জেন্টিনার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সাল্টার ভূতাত্ত্বিক ভ্যানিনা লোপেজ ডি আজারেভিচের একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, প্রায় ৫৫০-৬২৫ মিলিয়ন বছর আগে চাঁদ বছরে ২.৮ ইঞ্চি (৭ সেমি) পিছিয়ে যেতো।
"চাঁদ যে গতিতে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যায় তা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তা ঘটবে," বলছেন মি. ইউলেনফেল্ড।
তবে, এর ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় জুড়ে চাঁদ বর্তমানের তুলনায় অনেক ধীর গতিতে দূরে সরে গিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, আমরা বর্তমানে এমন একটি সময়ের মধ্যে বাস করছি যখন এই দূরে সরে যাওয়া (লুনার রিসেশন)-এর হার অস্বাভাবিকভাবে বেশি।
এই হারে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য চাঁদকে মাত্র দেড়শ কোটি বছর অপেক্ষা করতে হতো।
কিন্তু সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে চাঁদ তৈরি হওয়ার পর থেকে লুনার রিসেশনের যে প্রক্রিয়াটি ঘটছে তা অতীতে স্পষ্টতই অনেক ধীর গতির ছিল।
"এমুহূর্তে জোয়ারের টান যা হওয়া উচিত তার চেয়েও তিনগুণ বেশি," জানালেন রয়্যাল হলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড ওয়ালথাম।
এর পেছনে বড়ো কারণটি হতে পারে আটলান্টিক মহাসাগরের আয়তন।
পৃথিবীতে মহাদেশগুলি এখন যেভাবে অবস্থান করছে, তাতে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের অববাহিকায় একটি ধাক্কা তৈরি করছে, অর্থাৎ এই মহাসাগরে যে জল রয়েছে তা জোয়ারের কাছাকাছি হারে একবার সামনে এগিয়ে যায় এবং একবার পেছনে সরে আসে।
উদাহরণ দিয়ে ড. ওয়ালথাম বলছেন, মনে করুন একটি শিশুকে দোলনায় ঠেলে দেয়া হচ্ছে। যদি প্রতিটি ধাক্কার সাথে সাথে একই গতিতে আরও ধাক্কা দেয়া হয়, তাহলে দেখবেন দোলনার উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে।
"উত্তর আটলান্টিক যদি সামান্য একটু বেশি প্রশস্ত কিংবা সংকীর্ণ হতো তাহলে এমনটি ঘটতো না," বলছেন তিনি।
"আমরা যেসব মডেল তৈরি করেছি তাতে দেখা যাচ্ছে যে আপনি যদি কয়েক মিলিয়ন বছর পিছিয়ে যান, তখন মহাদেশগুলির অবস্থান ভিন্ন ছিল বলে জোয়ারের শক্তিও খুবই কম ছিল।"
কিন্তু ভবিষ্যতে এতে পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
মডেলিংগুলো ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, এখন থেকে ১৫০ মিলিয়ন বছর পর একটি নতুন জোয়ারের অনুরণন দেখা দেবে এবং তারপর এখন থেকে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর পৃথিবীতে যখন একটি নতুন "সুপার কন্টিনেন্ট” বা অতিকায় মহাদেশ তৈরি হবে তখন এটি বিলুপ্ত হবে।
তাহলে, আমরা কি শেষ পর্যন্ত এমন কোন ভবিষ্যৎ দেখতে পারি যেখানে পৃথিবীর আশেপাশে কোন চাঁদ থাকবে না?
বর্তমানে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাওয়ার হার এত উঁচু থাকার পরও, চাঁদ পৃথিবীকে সম্পূর্ণরূপে ছেড়ে যাবে এমন সম্ভাবনা নেই।
প্রায় ৫০০ কোটি থেকে ১০০০ কোটি বছরের মধ্যে সম্ভবত সূর্যের বিপর্যয়মূলক মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু তার অনেক আগেই সম্ভবত মানব সভ্যতা বিলীন হয়ে যাবে।
তবে যাই হোক, স্বল্প মেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমবাহ এবং হিমশৈলগুলোতে আটকে থাকা জল গলে যাওয়ার পরিমাণ হ্রাস করে মানব সভ্যতা নিজেই দিনের দৈর্ঘ্য কিছুটা কমাতে একটা ভূমিকা পালন করতে পারে।
"বরফ মূলত জোয়ারকে চেপে রাখে," ড. ওয়ালথাম উল্লেখ করছেন, প্রায় ৬০০-৯০০ মিলিয়ন বছর আগে যখন আমাদের গ্রহটি একটি ‘স্নো বল’ বা তুষারাচ্ছন্ন পৃথিবী নামে পরিচিত একটি বিশেষ হিমায়িত যুগে প্রবেশ করেছিল বলে মনে করা হয়, সেই সময় চাঁদের সরে যাওয়ার হার ছিল নাটকীয়ভাবে ধীর।
তত্ত্বগতভাবে, নাসার আর্টেমিস প্রোগ্রামের মহাকাশচারীদের পরবর্তী দলটি যখন চাঁদের দিকে উড়ে যাবেন তখন তারা বলতে পারবেন যে ৬০ বছর আগে অ্যাপোলো প্রোগ্রামে তাদের পূর্বসূরিদের চেয়েও তারা বেশি দূরত্ব থেকে পৃথিবীর ফিরে তাকিয়েছেন।
(যদিও এটা নির্ভর করবে পৃথিবীর চারপাশে চাঁদের উপবৃত্তাকার কক্ষপথের কোন পয়েন্টে তারা গিয়ে পৌঁছুবেন। কারণ, এর সবচেয়ে কাছের এবং সবচেয়ে দূরের বিন্দুর মধ্যে দূরত্বটি প্রতি ২৯ দিনে ৪৩,০০০ কি.মি. পরিবর্তিত হয়)।
তবে আমাদের যারা এখন পৃথিবীতে আছি, তাদের জীবন এতটাই সংক্ষিপ্ত যে প্রতিটা দিনের দৈর্ঘ্যের সাথে একটি করে পিকোসেকেন্ড যোগ হচ্ছে, আপনি যদি একবার চোখের পলক ফেলেন, তাহলেই এটা আপনি দেখতে মিস করবেন।